সবাই একসাথেই দৌড় শুরু করেছিলাম…
হঠাৎ এ কথাটা মনে হওয়ার কারণ ! হাতড়ে বেড়াচ্ছি। ও! মনে পরেছে।
আমার এখনকার Flat-owner,ভাল লোক।দিল্লীতে থাকেন।গত তিনবছরে কোনোরকম বিরক্ত করেননি। দেওয়ালে কোথায় পেরেক পুঁতেছি কি না, খুঁজে দেখেননি। ভাড়া ঠিক সময় জমা অবশ্য পড়ে যেত।যদিবা এক দুবার আমার ভুলো মনের জন্যই দেরী হয়েছে। কখনও ফোনে reminder দেন নি।সেদিন flat-owner দিল্লী থেকে সরাসরি আমার কাছে এসে হাজির।মুখে দারুণ প্রসন্নতা।কিছুসময়ের মধ্যেই জানতে পারলাম এই খুশী খুশীভাবের কারণটা।ওনার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে।পাত্র গৌহাটীর,তবে চাকরীসুত্রে বাইরে থাকেন।কথায় কথায় যা বোঝা গেল,ওরা অদূর ভবিষ্যতে তো নয়ই,কোনোকালে গৌহাটীতে বসবাস করবে কিনা সন্দেহ আছে। তবে flat-ownerএর ইচ্ছে, তাই উনি মেয়ের বিয়েটা গৌহাটীর নিজগৃহ থেকে দেওয়ার ইচ্ছা (যদিও দিল্লী ও অন্যত্র নিজের Flat আছে)। সুতরাং আমাকে flat খালি করে দিতে হবে।
এরমধ্যে,মাঝেমাঝেই বন্ধুদের sms আসে। বেশীভাগই হালকা,চটুল চুটকি বা তোতাপাখির মতো আওড়ানোর জন্য Management training এর কিছু বুলি বা quotation।আর সবকিছুতেই আমার কাজ হ’ল reply option-e গিয়ে কয়েকটা চটুল চুটকি পাঠিয়ে দেওয়া।বন্ধুবান্ধবীদের আশীর্বাদে চটুলচুটকির ভাড়ার(inbox)আমার বড়ই স্ফীত। মাঝেমাঝে আরো কিছু sms আসে,যেমন , সুময় পাঠালো,’কাল মানবের সোনারপুরের নতুন flat দেখে এলাম। centrally Air-conditioned। খুব সুন্দর interior decoration। মানবের’ত ভবানীপুরে নিজের flatছিল, আমি ভাবি। বা অতনু লিখলো,’একটা ভালোখবর আছে,আমার মেয়েটা Bombay IITতে M.Techএ পেয়ে গেছে’। কখনওবা সুময় লিখলো,’জিনিষপত্রের ভীষণ দাম বেড়েছে,রাজারহাটে নতুন flatটার Budget অনেক exceed করে গেছে’। আমি ভাবি ত্রিশবছর বয়েসে সুময়’ত নিজে দাড়িয়ে বাড়ি বানিয়েছিল, আবার flat কিনতে গেল কেন! শুনলাম,’ভাই রে ভাই,মেয়েটার জন্য একটা করে রাখলাম।যা দিনকাল আসছে’। আবার কখনও প্রবাল লিখলো,”দাদাভাই এসেছিল,এই মালয়েশিয়া,সিঙ্গাপুরে,তাই দিনতিনেকর জন্য গিয়ে একবার দেখা করে এলাম”। বা অনেকদিন কোনো sms না পেয়ে প্রবালকে লিখলাম,”কিরে চুপচাপ কেন?” reply এল,”নাহ্ রে,একটু ব্যস্ত ছিলাম।হঠাৎ একটা কাজ পেয়ে গেলাম,১২দিনের জন্য ইজ্রায়েল যেতে হয়েছিল। জেরুজালেম টা দেখে এলাম ,বুঝলি”।এইভাবে আর কিছু মনে হত কিনা জানিনা,তবে বেশ সবার সাথে আমিও বেশ frequency মিলিয়ে চলতে পারছি বোধ হত।
আবার কখনও মানবের sms এরকম। “অনেক কষ্টে visaটা আজ হাতে পেলাম।20th থেকে 30th যাচ্ছি Europe। Just vacation-এ”।
প্রমিত মাঝে মাঝে sms বা email করে, কখনওবা সোমালিয়া কখনও বা মার্সেই থেকে। আবার প্রশান্তমহাসাগরে সুনামীতে যখন জাপান বিধ্বস্ত,প্রমিত তখন প্রশান্তমহাসাগরের অন্য কোনো কোণায় ভাসতে ভাসতে,ওর চোখে দেখা চারধারের অপরূপ প্রকৃতির ছবি আঁকছে- ভাষা দিয়ে। তা’ emailএ পাঠিয়ে দিচ্ছে।
রাজীবটা আজকাল বড় চুপচাপ।তবুও শুনলাম,কাজের জায়গায় কি একটা করে,ভীষণ বাহ্ বা কুড়িয়েছে।দেশের পুরস্কার তো পেয়েইছে।আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
দেবজ্যোতি বিশেষ যোগাযোগ রাখে না। তবে New year; বিজয়াদশমী এসবে শুভেচ্ছা পাঠাতে কখনওই ভূলে যায় না। সেদিন হঠাৎ ফোনে বলল,”শোন,তোদের চৌরাস্তায় Marlin Gardens-এ আমার একটা Flat আছে(ও বাবা ওখানে Sourav-বাংলার গৌরব Gangulyর flat আছে শুনেছি)।তালা বন্ধ পরে আছে,’দেখিস’ত একটা ভাল ভাড়াটে পাওয়া যায় কি না’, বা ‘ওখানে এখন কি Rate চলছে। ভাল দাম পেয়ে গেলে বেচে দেবো।সবকিছুতেই আমার প্রাপ্তিস্বীকার একটা হালকা অপ্রাসঙ্গিক চটুল চুটকির sms পাঠিয়ে।
পান-সিগারেট দোকানের সামনে দাড়িয়ে রাজামাপ-এর সিগারেটে টান দিচ্ছি।এক ঝটকায় মাথায় সবচিন্তা মাথায় বয়ে যাচ্ছে।আমার’ত বন্ধুদের তুলনায় ছোট-বড়,কম-বেশী,সফল অসফল কোনোদিন মাথায় আসেনি।একজনকে বড় দেখাতে,অন্যকে ছোট করা বা কাউকে ছোট করতে গিয়ে অন্যকে বড় দেখানো,এ তো বেশীভাগ মানুষের প্রকৃতি। আর এখন News channel/Newspaper গুলো’ত এই বিক্রী করেই মুনাফা কামাচ্ছে। আজ মাথায় এসব চিন্তা আসছে। Just একটা কথায়,”flatটা ছেড়ে দিতে হবে”।
আমার এতোদিনের ধারণা ছিল,আমরা সবএকসাথেই দৌড় শুরু করেছিলাম। আর আমি slowly and steadily পিছিয়ে পড়েছি।অনেক ভেবে দেখলাম,আমার এই ধারণা শুধু ভুল যে তাই-ই নয়। এইধারণা আমার সহপাঠী, সহযোগী, বন্ধুদের কিছুটা অসম্মান,অকৃতজ্ঞতা দেখানো হয়ে যায়। বাস্তবে ওরা আমার সাথে দৌড় শুরু করেনি। ওরা আমার জন্য দাড়িয়ে অপেক্ষা করেছিল।আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।আমি ভুলেই গেছিলাম,আমার প্রকৃত ক্ষমতা। ভাবতে শুরু করেছিলাম, আমি ও ওদের সমকক্ষ।
আজ flat ছাড়ার notice পাওয়ার পরেই,একটা ভাড়াবাড়ী খুঁজতে বেড়িয়ে দেখছি, কিছুতেই একটা পছন্দসই বাড়ী পাচ্ছি না।যদিবা পাই, আর একচিন্তা মাথায় ঘুরছে।দু-এক বছরপরে আবার এই বাড়িওয়ালা যদি বাড়ি ছাড়ার notice দেয়!...উপলব্ধি করলাম। আমি অনেক পিছিয়ে পরেছি। অনেক যোজন পিছনে।গতি বাড়ানোর ক্ষমতা নেই।ভীষণ হাঁফ উঠছে।দমবন্ধ করে দিচ্ছে।সিগারেটে আরো ঘনঘন টান দিচ্ছি। হঠাৎ এক বেশ পুরুষালী আওয়াজ কানে এল।“জেব মে রূপাইয়া হ্যায়,নিকল্ কে লিজীয়ে।অউর এক ঠাণ্ডা Frooti দিজীয়ে তো”। কথাটা শুনে না তাকিয়ে থাকতে পারলাম না।দেখি! একটা ভিখারী,হ্যাঁ একদম পুরোদস্তুর ভিখিরী, ওর কণুইয়ের পরে হাত দুটো নেই। সে Frooti চাইছে,দাম পনেরো টাকা।এই প্যাঁচপ্যাঁচে গরমে এটাই তার বিলাসিতা।
******
সেদিন ডাঃ বিনায়ক সেন-এর interview শুনছিলাম। ছত্তিশগড়;ঝাড়খণ্ড;ওড়িশা আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় তপশিলী জাতির 50% আর উপজাতির 40% এরই Body-Mass Index 18.5 এর কম। UN Scale এ এইসব এলাকা Famine affected declare করা উচিত। এইসব লোকের নিজস্ব Natural Possession বলতে জল;হাওয়া আর কিছু জমি।সেগুলোও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। This is also a type of violence- the Structural Violence…
সর্বশক্তিমান আমায় দুটো সবল হাত,পা ও চোখ দিয়েছে,মাথা দিয়েছে।সর্বোপরি প্রায় নীরোগ একটা দেহ দিয়েছে। আর কি চাই? এ সব শুনে সুময় হয়তবা বলবে,”ব্যাপারটাকে বড় simplify করে দিচ্ছিস।“
যখন এভাবেই ভাবছিস তখন ভাড়া বাড়িটাই এর সাথে মানানসই। আমরা কে কোথা থেকে এলাম কোথায়ই বা যাবো। একটা নাট্যমঞ্চে নিছক অভিনয়ই করছি । শৈশব গেল, যৌবন পার। ঝুলন সাজানর মত একবার ভুবনেস্বর,একবার গৌহাটির ৫ তলায়,অথবা আরও অন্য কোনোখানে নতুন নতুন ডিজাইন দিয়ে ডিভাইন সংসার।
ReplyDeleteপারব আমরা এমন এনজয় করতে যারা জীবনে খুঁটি পুতে ফেলেছি?
প্রথমেই ব'লি, বন্ধুদের প্রতিনাম (ইংরেজীতে equivalent বোধহয় pseudonym, French-এ 'num de plum') গুলো খুব ভাল বেছেছিস, বেড়ে হয়েছে। তবে বুঝলাম 'নির্মাল্য'-র সাথে তাল মিলিয়ে নাম খুঁজতে গিয়ে বিপাকে প'ড়েছিস। হূঁ-হূঁ বাবা! আমার নাম আর পাঁচটা plebeian নামের চেয়ে আলাদা। এ মাল যে সে মাল নয়, এ মাল অন্য মাল!
ReplyDeleteযাগ্ গে যাগ। যেটা ব্লগে এড়িয়ে গেছিস সেটা হল নতুন বাড়ী খুঁজে পেয়েছিস কি না। পেলেও মালপত্র স্হানান্তরের ব্যবস্হাদি হয়েছে কি না। নতুন বাড়ী মেয়ের স্কুল বা তোর অফিসের কাছাকাছি হবার সুযোগ কতটা? সামনেই বর্ষা, দেখিস জল জমে যাওয়ার কোন past records আছে কি না।
কেজো কথাগুলো ব'লে নিলাম; এবারে আসল কথায় আসি।
আমি মনে করি, আমাদের সৌভাগ্য যে পারস্পরিক প্রতিযোগীতায় আমরা কেউই সেভাবে নামি নি। সোজা কথা: নামলে বন্ধুত্বটা টিঁকত না, টিঁকলেও চুন-সুরকী খসে পড়া দালানের মত দাঁড়িয়ে থাকত; ঢুকতে গেলে সাত-পাঁচ ভেবে, ভয়ে ভয়ে ঢুকতে হত, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে আসার ইচ্ছে নিয়ে। জীবনে achieve করেছি বলতে গেলে যা যা বলতে হয়, তার কোনটাই না হ'লে তোরা কি আমায় দূরে সরিয়ে রাখতি? মনে তো হয় না। Achievement-র সংগার মধ্যে কোথাও যেন অন্যের দৃষ্টিতে নিজেকে ঝালিয়ে নেওয়ার একটা ব্যাপার আছে। হয়তো নিজের professional বা personal জগতে এই অন্যের দৃষ্টি আমি অজান্তেই খুঁজে বেড়াই। কিন্তু, ঠেকের জগতে ঢোকার সময় সেই দৃষ্টি খুঁজি কি? না। বরং সারাদিন পরনে থাকা জীবনযোদ্ধার বর্ম সরিয়ে রেখে বন্ধুত্বের 'সব-দেখা-যায়' কৌপীন প'রে ঢুকি এটা জেনেই, তোরা আমায় দেখবি আমি আদতে যা, তাই ভাবে। ঠেকের দেশে সমকক্ষতার হিসেব হয় না; সহমর্মিতার কমতি প'ড়ে না, সহ্রদয়তা আপনাআপনিই জানান দিয়ে যায়।
য়দি কোনদিন এমন হয় যে তোর নিজস্ব বাড়ী নেই ব'লে - অর্থাত্ তোর উপমানুসারে, তোর জন্য দাঁড়িয়ে থেকে থেকে হাল ছেড়ে দিয়ে, 'দু: শালা, ছোটকনটাকে দিয়ে কিছু হবে না' ব'লে হনহন ক'রে achieve করার পথে এগিয়ে গিয়েছি ব'লে - তোর বাড়ী যেতে নারাজ হয়েছি, সেদিন তোর এই ব্লগটার কথা ম'নে করিয়ে দিস্।
হঠাত্ ম'নে প'ড়ল: বিগত বেশ কয়েক বছরে খুব কম বার কেউ বলেছে যে 'নির্মাল্য, তুই এই জিনিযটা (যে কোন জিনিয) ভাল করতে পারিস (বা করেছিস বা একসময় করতে পারতিস)'। শুধুমাত্র - I repeat, শুধুমাত্র - তোরা কেউ কেউ বলেছিস, বিভিন্ন সময়ে। এই প্রশংসা না চাইতেই পেয়েছি। দূরে সরে গেলে কি এইটি পেতাম?
'এমন বন্ধু আর কে আছে....তোমার মতো..?'