Tuesday, 29 November 2011

কোলার ই-মেল-এর ctrlC ও ctrlV


TO:
Tuesday, 29 November 2011 2:27 AM

Message Body



তাঁর সব সময়ের সঙ্গী, যেটা দিয়ে মুখ ঢেকে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হতেন, সেই সবুজ গামছটা ছিল না। মুখটা তাই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। শরীরটা মুড়ে দেওয়া হয়েছিল লাল শালুতে। অন্ধ্রপ্রদেশের করিমনগর জেলার পেড্ডাপল্লিতে, বিশাল মাঠে যে চিতা জ্বলে উঠল রবিবার বিকেলে, তাতেই ছাই হয়ে গেল লাল শালু ঢাকা শরীরটা।
শেষ হয়ে গেল মাল্লোজুলা কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজির অধ্যায়। -Anandabajar
*********************************************************


ডান দিকের চোখের জায়গাটা খালি। নীচের চোয়ালের বেশির ভাগটাই উড়ে গিয়েছে। মাথার ডান দিকে আঘাতের চিহ্ন। শুধু সামনের দাঁতের উঁচু পাটি থেকেই চেনা যাচ্ছে। ভারভারার অভিযোগ, “গুলিতে তিনি মরেননি। বেয়নেটে খুঁচিয়ে মারা হয়েছে। ডান চোখ উপড়ে নেওয়া হয়েছে। ইলেকট্রিক হিটারের উপরে দেহ ফেলে অত্যাচার করা হয়েছে। তাই পা দু’টো কালো হয়ে গিয়েছে। বাঁ পায়ের তলার দিক কেটে বাদও দিতে হয়েছে।” -**********************************************************
পেড্ডাপল্লির বাড়িতে ভিড়ের মধ্যে এ দিনও দেখা গিয়েছে জগন্মোহন সিংহকে। কিষেণজি-র ছোটবেলার বন্ধু, অনুগামী। তেলেঙ্গানা ও মাওবাদী-আন্দোলনের সঙ্গী। সকাল থেকেই জনতাকে ফুল সরবরাহ করছিলেন। বিকেলে সেই জগনকেই দেখা গেল, একা-একা প্রিয় বন্ধুর চিতায় কেরোসিন ছিটিয়ে চলেছেন। কাছে যেতে চোখ মুছে বললেন, “জানেন, ও বলত, কমিউনিস্ট হওয়াটা বড় কথা নয়। কমিউনিস্ট জীবনচর্যাটাই বড় কথা। আর কমিউনিস্ট হিসেবে মৃত্যু আরও বড়।” গলা বুজে এল তাঁর।-Anandabajar

*************************************************************************

তিনি কিষেণজি। সাড়ে পাঁচ ফুটের সেই চেহারাটাকে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে যখন বুড়িশোলের জঙ্গলে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলাম, প্রথমে ঠিক বিশ্বাস হয়নি। কাছ থেকে গিয়ে দেখে বুঝলাম, চোখের ভুল নয়। গুলিতে ক্ষতবিক্ষত যে লাশটা জমিতে বাঁ দিকে কাত হয়ে লুটিয়ে আছে, সেটা সিপিআই (মাওবাদী)-র তিন নম্বর ব্যক্তিটিরই। আর যাই হোক ওই হাতের পাঞ্জাটা ভুল হওয়ার নয়। সেই পাঞ্জার চাপ যে তিন তিন বার অনুভব করেছি নিজের ডান হাতে।
তিন বার একেবারে সামনে থেকে দেখেছি। প্রতিবারই পরনে এক পোশাক। কিছু স্মৃতি আজ না চাইতেও ঘুরেফিরে আসছে মাথায়। ২০০৯-এর ১৮ জুনের আগে পর্যন্ত শুধুই নাম শুনেছি। ২০০৪ সাল থেকে জঙ্গলমহলে মাওবাদী সংগঠনের ভার ছিল তাঁরই কাঁধে। ঝাড়গ্রামে থেকে কাজ করার সুবাদে কিষেণজির নাম পুলিশমহলের কাছে বারবার শুনেছি। জানতাম ভাল নাম মাল্লোজুলা কোটেশ্বর রাও। অন্ধ্রের লোক। মাওবাদীদের পলিটব্যুরো সদস্য। ২০০৭ সাল থেকে লালগড়ে আন্দোলন গড়ে তোলার পিছনে তিনি। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়ে বিস্ফোরণের পরিকল্পনা তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত বলে পুলিশের দাবি। তার পর থেকে লালগড়ে যে অবরোধ-আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার রাশ ছিল তাঁরই হাতে। তখনও পর্যন্ত কিষেণজি বলতে আমার কাছে ভাসা ভাসা, টুকরো টুকরো এই সব তথ্য। আর তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠা কিছু ‘মিথ’। তাঁকে নাকি চোখে দেখা যায় না! এই আছেন বেলপাহাড়ির জঙ্গলে, তো খানিক পরেই তাঁকে নাকি দেখা যায় লালগড়ের জঙ্গলঘেরা গ্রামে। দু’হাতে বন্দুক চালানোয় সমান দক্ষ। অক্লেশে হাঁটতে পারেন মাইলের পর মাইল জঙ্গল-পাহাড়ি পথ।-Anandabajar

*************************************************************************************

Vebechhilam Du fota chokher jol felbo...jol niye gelo ei lekhata;;; Kishanji-der janya o toh ank pran beghore gelo
****************************************************************************************
তাঁকে খোঁজে আহত পেঁচা। তাঁকে খোঁজে পা ভাঙা কাঠবিড়ালি। তাঁকে খোঁজে চাঁদনি রাত। তাঁকে খোঁজে থইথই জ্যোৎস্না।
ছেঁড়া নক্ষত্রেরা তাঁকে খোঁজে। খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত ভোরের ঘাসফড়িং। স্বচ্ছতোয়া এক নদীও তাঁর খোঁজে পাগলপারা। তাঁকে খুঁজছে এক আকাশ রোদ্দুর।
বাড়ির বারান্দায় এখনও দুলছে বাবুইয়ের বাসা। সঙ্গে বাঁধা একটা ভাঙা মৌচাকও। সেদিকে তাকিয়ে উন্মনা স্বচ্ছতোয়া বসু। অযোধ্যা পাহাড়ে নিহত সৌম্যজিৎ বসুর স্ত্রী। চশমাটা খুলে খালি চোখে বাবুইয়ের বাসাটা দেখছেন আর বলছেন, “কোনওদিন শুনেছেন, পাখির বাসায় কেউ জ্যোৎস্না ভরে আনে? কোনওদিন শুনেছেন, পাখির ডানা ভাঙলে কেউ কাঁদে? কোনওদিন শুনেছেন, চাঁদের সঙ্গে কেউ ফিসফিসিয়ে কথা বলে? ও বলত। পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখতে গিয়েই তো ও হারিয়ে গেল।”
স্ত্রীর নাম স্বচ্ছতোয়া। ছেলের নাম আরণ্যক ও রোদ্দুর। নদী, অরণ্য, রোদ্দুর তাই ঘরেই ছিল ভূগোলের শিক্ষক সৌম্যজিতের। বাইরে ছিল কূলপ্লাবী জ্যোৎস্না। গত বছরের লক্ষ্মীপূর্ণিমার চাঁদ তাঁকে ঠেলে দিল অন্ধকার মৃত্যুর দিকে। কয়েক মাস পরে সৌম্যজিতের দেহ যেদিন ব্যান্ডেলের বাড়িতে পৌঁছল, সেদিনও ছিল বানভাসি জ্যোৎস্না।
এতদিন আশায় ছিলেন। দুর্মর আশা। বাড়িতে ফিরবেন সৌম্যজিৎ ও পার্থ। বন্ধু পার্থ বিশ্বাসের সঙ্গে অযোধ্যা পাহাড়ে ছুটেছিলেন সৌম্যজিৎ। তার পর হঠাৎ নিখোঁজ। চারদিকে হইচই। কোথায় গেলেন? সৌম্যজিতের দাদা অভিজিৎবাবুর গলায় ক্ষোভ। বললেন, “এক নেতা বললেন, ফিরিয়ে আনবই। এক নেত্রী বললেন ভাইফোঁটা দেব। পুলিশ, আমলা সবাই আশায় রাখল। কিন্তু ভাই কি বেঁচে ফিরল! কেন আমাদের সঙ্গে এই তঞ্চকতা!”
সৌম্যজিতের ছেলেবেলা কেটেছে অসমের চা বাগানে। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। দূর পাহাড়ে রাখালের বাঁশি। প্রকৃতি মিশে গেল রক্তে। সৌম্যজিতের আর এক দাদা সুজিতবাবু বললেন, “পাহাড়ের প্রজাপতিগুলি ছিল খুব বড়। ওরা যখন গাছে বসে থাকত, একটু দূর থেকে টুপি দিয়ে হাওয়া দিতাম আমি আর ভাই। সেই হাওয়ায় টাল খেয়ে পড়ে যেত একটি-দু’টি প্রজাপতি। ভাই ওদের নিয়ে আসত বাড়িতে। একটা রঙিন বাক্স ছিল। প্রজাপতিটাকে ওখানে রেখে চারদিকে সাজিয়ে দিতাম রঙ্গন ফুল। রঙে রঙে ভাইয়ের চোখমুখ ঝিকমিক করত। কিছুক্ষণ পরে প্রজাপতিটাকে ছেড়ে দিত গাছের ডালে। আমাদের একটা পোষা হরিণও ছিল। ভাই ওর সঙ্গে খেলত। খ্যাপা ছিল খুব। না হলে কেউ কার্গিলে যায়!”
কার্গিল?
দেওয়ালে বাঁধানো একটা ছবি দেখালেন স্বচ্ছতোয়া। বালির বস্তার আড়ালে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে তাঁর খ্যাপা বর। পিছনে দাঁড়িয়ে এক সেনা।
সত্যিই যুদ্ধে গিয়েছিলেন নাকি?
অভিজিৎবাবু বললেন, “সত্যিই এটা কার্গিলের ছবি। তখন কত বয়স? কলেজে পড়ে। একদিন বলল, ‘সবাই যুদ্ধের জন্য টাকা দিচ্ছে। কিন্তু আমি যুদ্ধেই যাব।’ আমরা আটকাতে পারিনি। এক বন্ধুর সঙ্গে যুদ্ধে চলে গেল। থাকলও বহুদিন। যুদ্ধ থেকে ফিরে আবার পড়ল পাখি আর পোকামাকড় নিয়ে।”
বাবুইয়ের বাসাটা কি সৌম্যজিৎই ভেঙে এনেছিলেন?
স্বচ্ছতোয়ার মুখে ভাঙা বাসার আঁধার। খানিক নীরবতা। বললেন, “ভাঙেনি। পাখির বাসা কোনওদিন ভাঙত না। গাছের নীচে কুড়িয়ে পেয়েছিল। আমার বাড়ি তো পশু-পাখির হাসপাতাল। পা ভাঙা কাঠবিড়ালি খুঁজেপেতে নিয়ে আসত। ডানা ভাঙা পেঁচাও এনেছিল। পেঁচা খুব ভালবাসত। আর ভালবাসত চাঁদ। বিভূতিভূষণ ও জীবনানন্দ খুব প্রিয় ছিল। ডুয়ার্সের জঙ্গলে একবার হাতি তাড়া করেছিল। গাছে উঠে পড়েছিল ও। উফ, কী সাঙ্ঘাতিক!” স্বচ্ছতোয়ার চোখেমুখে রোমাঞ্চকর বিচ্ছুরণ। যেন পুজোর মণ্ডপে পাশেই বসে সৌম্যজিৎ। চাপা গর্বের সঙ্গে তিনি প্রতিবেশীকে শোনাচ্ছেন খ্যাপা বরের বীরগাথা।
আপনিও যেতেন?
যেতাম। তবে পুজোয় তেমন যাওয়া হত না। পাড়াতেই মেতে থাকতাম। গত বারও অযোধ্যা পাহাড়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যাওয়া হয়নি। পুজোর পরেই কাঁধে বাইনোকুলার ঝুলিয়ে চলে গেল। তখনও কি জানতাম, ও চলে যাচ্ছে চাঁদের পাশে। চাঁদই ওকে কেড়ে নিল। আমি আছি ছেলে রোদ্দুরকে নিয়ে।
সাড়ে তিন বছরের রোদ্দুরের একটা সাইকেল আছে। মৌমাছির মতো। বাবার সঙ্গে সে সাইকেল চড়ত। স্বচ্ছতোয়া বলেন, “বিশ্বকর্মার দিন ছেঁড়া নেকড়া দিয়ে সাইকেল মুছছিল। হঠাৎ বলল, মা, বাবার বাইকটাও মুছে দিই। বাবা কোথায় মা?”
বাবাকে খুব খোঁজে?
রাতে বিছানায় খোঁজে। আমাকে বলে, ‘মা, বাবার পাশবালিশটা কাউকে দেবে না। ওটা শুধু বাবার। বলো না মা, বাবা কোথায়?’ আমি বলি, যা কিছু ভাল, এই যেমন মেঘ, বৃষ্টি, গাছ, কাঠবিড়ালি, সবের মধ্যেই তোর বাবা আছে। তোর বাবা তো খুব ভাল, খুব ভাল...।
বৃষ্টি ঝরছে স্বচ্ছতোয়া নদীতে। গলার কাছে, বুকের কাছে, আটকে থাকা নুড়ি-পাথর ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টির ধারায়। ছেঁড়া সেতারের মতো শোনাচ্ছে ওর গলা। বললেন, “পাগল ছেলের কথা শুনবেন? এই তো সেদিনের কথা। সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছিল। চারদিক ঝাপসা। দেখি, জানালার ধারে হাতটা নিয়ে একবার মুঠোটা খুলছে, একবার বন্ধ করছে। হঠাৎ আমাকে দেখে বলল, ‘মা, তুমি যে বললে বৃষ্টির মধ্যে বাবা আছে। আমি তো কত বৃষ্টি ধরলাম। কোথায় বাবা? কোথায়?”
বৃষ্টি থামছে না।

No comments:

Post a Comment

Note: only a member of this blog may post a comment.