Monday, 2 January 2012

অমিতের লেখা ২৭শে ডিসেম্বর ২০১১



আজ ২৫শে ডিসেম্বর।

আলজিরিয়ার একটা বন্দরের একটু দূরে ভাসছি।বেশ কয়েকবছর হ’ল ২৫শে ডিসেম্বর(আমার মাতৃভাষায় বড়দিন) কেটে যাচ্ছে সাগরে ভেসে ভেসে। ২০০৭---এষ্টোনিয়ার সাগরে,২০০৮-তাইওয়ান থেকে সিঙ্গাপুরের পথে,২০০৯...সিঙ্গাপুর ইষ্টার্ন পেট্রলিয়াম অ্যাঙ্করেজে।২০১০, ওয়েষ্ট অ্যাফ্রিকা...আইভরি কোষ্ট...বেনিন বন্দর থেকে ৭০মাইল দূরে আটল্যান্টিকের বুকে,আর এইবার আলজিরিয়ার আর্জু বন্দরের ১৫/১৬মাইল দূরে। ভারী চমৎকার নাম-আর্জু।

জবরদস্ত গৃহযুদ্ধ চলছে আলজিরিয়ায়

নীলকান্তমণির মতো ঝকঝকে নীল দিনটা গেল আজ।সমুদ্র নীল,আকাশ নীল,নীল নির্জনে দাপটের রাজ শেষ করে সূর্যদেবও এবার বিদায়ের পথে।ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভাঙা হাটের ফিসফিসানি..অস্তে গেল দিনমণি..আসিল গোধূলি।বিসর্জনের একপ্রস্ত সিঁদুরখেলা হ’ল আকাশে..কালকে বোধনের থালা হাতে জাগবে সমুদ্র...কাল সূর্য ফিরলেই নিজের সিথির সিঁদুরেূ আকাশের কপালে টিকা এঁকে দেবে...আজ সন্ধ্যার এটাই অঙ্গীকার

২৫শে ডিসেম্বর আমার দাদু(ঠাকুরদাদা)- মৃত্যুদিবস ভবানীপুর-এর রামরিক হাসপাতালে এইদিন বেলা একটা নাগাদ ১৯৭৮সালে বিপত্নীক আমার দাদু... ঠাকুমার কাছে চলে গেলেনএসেছিলেন সপত্নীক সপরিবারে ঢাকা থেকে,স্বর্গে চলে গেলেন কলকাতা থেকে পুত্রকন্যাদের রেখে জীবনযাত্রায় একপুত্রের মৃত্যুশোক- ভোগ করে গেলেন ছিলেন আপাদমস্তক বাঙালী...এবং বাঙাল যাঁরা সেদিন কাঁধ ছিলেন...তাঁরাও বোধহয় অনেকেই আজ নেইযে ডাক্তার ওখানে ভর্ত্তি করিয়েছিলেন...গতবছর Pancreas Cancer ভুগে তিনিও ৬৪বছর বয়সে মারা যান...জীবনের কাহিনী দুস্তরগতিতে সামনে এগিয়ে চলে অনেক মুখ হারিয়ে যায় প্রতি ঢেউয়ের মত কেবা কাকে মনে রাখে

দিনটা বাবা আমার অবিবাহিত কাকু,আমার নিঃসন্তান দুই পিসি আর পিসেমশাইরা মিলিত আমার বউ আমার ছেলেকে নিয়ে যায়পিসিরা- রাঁধে...আমার বউ সেজেগুঁজে বাগানে ফুল তোলে..ফল পাড়ে..ওর ওড়না হাওয়ায় ওড়ে..আমার ছেলে মোবাইলে এদিক ওদিক ছবি তোলে..ফেসবুকে পোষ্ট কোরে দেয়কত ছবি..কেক-এর ছবি সান্তাক্লজের ছবি নতুন জামায় ওর নিজের ছবি..আরবেশ ভাল দেখতে লাগছে টাইপেরওর মা- ছবি...

অন্যদের- আছে বাবা-কাকুর নিরুত্তাপ ছবি..রোগা হতে থাকা শীর্ণকায় ছোটপিসির ছবি,দুই পিসেমশাইর পাশাপাশি ছবি,রান্নাক্লান্ত বিশাল চশমার আড়ালে বড়পিসীর ছবি..নীচে আমার ছেলে লিখে দেয়...Christmas in our Farmhouse.এইসব লিখলে বন্ধুমহলেরেলাবাড়ে Farmhouseই বটে...সূর্য্যি পটে নামে,রাখাল ঘরেফেরে,,দুরন্ত বালকের দল ফুটবল অথবা ক্রিকেটখেলা সাঙ্গকরে হৈহৈ রবে বাড়ি ফেরে...সাইকেলের পাগলা ঘণ্টি বাজিয়ে টিউশন পড়তে যায় পড়ুয়ার দল..কিন্তু আমার বাবা কাকাকে ঘরেতোলার কথা মনে থাকে না...জীবনজুড়ে আমাদের অনেক জল্পনাকল্পনায়...এই বুড়োমানুষগুলো এখন শুধু Laughing Budhaর জীবন্ত ষ্ট্যাচু

আমি ফোন করি...কাকু তোলে..এমনিতে কানে কম শোনে কিন্তু কানে ফোন লাগিয়ে শুনতে পায়..ল্যাণ্ডলাইন। বেশ কয়েকহাজার মাইল দূর থেকে ভেসে আসে কাকুর বয়সজনিত সামান্য অসংলগ্ন আওয়াজ...”আমরা সবাই ভালো আছি...তুই ভালতো?”

এইটুকু যদি ভগবান আমার সারাজীবনের জন্যে রেকর্ড করে রেখে আমায় বার বার শোনাতে পারতেন...এই ওদের ভালোথাকা...ওদের থাকাটা..বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে..আরও কিছুকাল ভালো রেখো ওদের ঠাকুর...আমার হাতের শেষ জল পান থেকে ওদের বঞ্চিত কোরো না।

আমার জীবন কেটে যায় ফেসবুকনামক জানলা ওপারে উঁকি মেরে। ফেসবুক এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ...চীন আর ভারতের পরেই এর জনসংখ্যা। নাগরিক জীবনে অদ্ভুত অভিঘাত..what an impact. মনের ছায়া পথে বন্ধুর হাত ধরে চলা। আড্ডা মারার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ।কবিতে কবিতে কাব্যমূখর। বাদশাহ্ আকবরের পরিবর্তে রাজাধিরাজ মহাকালের সভা।কোথাও বীরবল কোথাও গালিব...কোথাও চালচিত্র ডোকরা..থেকে পিকাসো। কথার খই ফোটে আর তাতেই ফুটে ওঠে প্রেমের গোলাপ...অদ্ভুত সব abbreviation”LOL”,”P”.কখনো হাত বাড়ালেই বন্ধু কখনওবা মৃদু তিরস্কার...কোথাও অভিমান..আর অর্দ্ধাঙ্গিনীর অঙ্গনে প্রচুর অভিযোগ। সব নিয়ে ফেসবুকের দুনিয়া।

বুক কাঁপিয়ে দিয়ে যায় এক একটা পোস্ট। মনের বাগান থেকেও এক একদিন খবর আসে কারো কারো চলে যাওয়ার।অকষ্মাৎ শেষ পরিণতি...অপরিণত জীবনের অকল্পনীয় অবসান।পরমযত্নে তার ফেসবুকে ফিরে গিয়ে আর একবার চোখ বোলাই...কত ছবি স্কুল-কলেজ-কর্মস্থান..বেড়াতে যাওয়ার। কিছু ভাললাগা গান,কিছু সরস টিপ্পনী..কেউ বউ-মেয়ের সাথে লোনাভালায়..কেউ হাসব্যান্ড-এর সাথে সোফাসেট-এ হাসিমুখে।কাল ওরা ছিল,আজ ওরা নেই।হয়ত এখনো রয়ে গেল কারো কাছে কোনো ঝুলে থাকা...Friend’s request. জীবন কেন এরকম বেলা-তা’তে বালির গড়া সৌধ? বাতাসের এক দমকে,ঢেউয়ের একচুমুকে সব নিঃশেষে শেষ। বেশ’ত ছিল এই শরীর...রক্তমাংসে গড়া..চেতনা কেন দিলে..দিলে’ত মমতা কেন দিলে..এমন অশ্রু মেদূর স্মৃতিকাতরতা কেন দিলে..চলে যাওয়ার পর এই চেতনাবোধ কোথায় হারায় ঠাকুর। আমি চলে গেলে আমার এই অনুভূতি যা দিয়ে আমি আকাশের নীল-এ মেঘের ভেলায় ভেসেছি-তা কি সাগরের ঢেউ হয়ে কোনো শিশুর পদযুগল সন্তর্পণে ধুয়ে দিয়ে যাবে কোনো অচেনা সাগরপাড়ে...অথবা হাওয়া হয়ে মন হুহু করে বয়ে নিয়ে যাবে কোনো আনমনা কুমারীর সম্বিত

জানলায় তবুও চোখ রাখি। Twinkle Twinkle little starsএর মতো Little hearts কারো প্রোফাইলের লেখার পাশে পাশে ফুটে উঠছে।ভাইপো-ভাইঝিরা realationshipএ আবদ্ধ হচ্ছে। কোথাও Yamতুলছে...এদিকে মদন কোথাও চোখে কাজল পরিয়ে দিচ্ছে। যেদিন আবার কারোর যাবার খবর আসবে...মনে পড়বে লেখক অনিরুদ্ধ বোস-এর এই কটা লাইন

“.....আর র’বে

পশ্চাতে আমার নাগকেশরের চারা

ফুল যার ধরে নাই

.....আর র’বে

খেয়াতরীহারা “এপারের”ভালবাসা

বিরহ স্মৃতির অভিমানে

ক্লান্ত হয়ে ফিরিবে সে পশ্চাতের পানে”

1 comment:

  1. অমিতের কাকার কথা পড়ছি...মনে পড়ছে...
    Stateবাসে ঝুলন্ত Helper...আমার দেখা এই প্রথম। কলেজ থেকে ফিরছি আমরা সবাই,যথারীতি বাসে বেশ ভীড়।হঠাৎ শুনি,প্রতি STOPএ নেমে Helper প্যাসেঞ্জার ডাকছে। হাঁকছে পরের STOPগুলোর নাম। গলার আওয়াজখানা যেন খুব চেনাচেনা লাগছে! গলাবাড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখি- Helper স্বয়ং আমাদের 'কোলা(অমিত)।...মাঝেমাঝে চলন্তবাসের ভিতরে এসে,অমিতের অনুরোধ (Specially আমাদের),"তোরা মাইরী সবাই টিকিট কাটিস,কেউ WTকরিস না। আমার কাকা CSTCতে আছে'ত,তোরা টিকিট কাটলে-আমার কাকা-টা incentiveপাবে।"

    ReplyDelete

Note: only a member of this blog may post a comment.